হজ্জের রুহানী শিক্ষা
ড. মুহাম্মাদ খলিলুর রহমান মাদানী
ভূমিকা: হজ্জ মুসলিম উম্মাহর একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। হযরত ইমাম আবু হানিফা (রা) হজ্জ করার পূর্ব পর্যন্ত ঠিক বুঝতে পারেননি যে, ইসলামী ইবাদাতসমূহের মধ্যে কোনটি সর্বোত্তম; কিন্তু যখনই তিনি হজ্জ করে তার অন্তনির্হিত কল্যাণ প্রত্যক্ষ করলেন, তখন স্পষ্ট কন্ঠে বলে উঠলেন, “হজ্জ-ই সর্বোত্তম ইবাদাত”। শারিরীক ও আর্থিক ত্যাগ-কুরবানীর চুড়ান্ত পরীক্ষা দিয়ে পবিত্র হজ্জ পালন করে একজন হাজী সাহেব নিষ্পাপ, নিষ্কলুষ শিশুর ন্যায় পূত:পবিত্র হয়ে জান্নাতের মেহমান হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেন।
মহানবী (সাঃ) বলেন: الحَجُّ المَبْرُورُ لَيْسَ لَهُ الجَزَاءُ إلا الجَنَّةُ. (احمد ১৫-৯১)“কবুল হজ্জের বিনিময় নিশ্চিত জান্নাত।” (মুসনাদে আহমাদ: ১৫/৯১)
অন্য হাদীসে বলা হয়েছে: “যিনি হজ্জ করলেন, ঝগড়া-ঝাটি, অন্যায়, ফাসেকী ও নাফরমানী কোন কাজ করেননি, তিনি মায়ের পেট থেকে সদ্য ভূমিষ্ট নিষ্পাপ সন্তানের ন্যায় হয়ে গেলেন। (সুনান)
আল্লাহ তায়ালার বাণী
وَأَذِّنْ فِي النَّاسِ بِالْحَجِّ يَأْتُوكَ رِجَالًا وَعَلَى كُلِّ ضَامِرٍ يَأْتِينَ مِنْ كُلِّ فَجٍّ عَمِيقٍ (الحج-২৭)
আপনি মানুষের মাঝে হজ্জের ঘোষণা পত্র জানিয়ে দিন। লোকেরা পায়ে হেঁটে, বিভিন্ন যানবাহনে পৃথিবীর সকল অঞ্চল থেকে দলে দলে আপনার দিকে (হজ্জের জন্য) ছুটে আসবে। (সুরা আল-হাজ্জ-২৭)
মহান আল্লাহ তা’য়ালার এ ঘোষণা অনুযায়ী ঐ সময় থেকেই অদ্যবধী প্রতি বছর মহান মালিকের ডাকে সাড়া দিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে লক্ষ-কোটি মুসলিম সমবেত হয়ে সবাই একই আওয়াজ তুলে বলে:
لَبِّيْكَ اَلَّلهُمَّ لَبِّيْكَ لَبِّيْكَ لا شَرِيْكَ لَكَ لَبِّيْكَ إِنَّ الحَمْدَ والنِّعْمَةَ لَكَ والمُلْكَ لا شَرِيْكَ لَكَ.
উচ্চারণ: লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইকা. লাব্বাইক লা শারীকা লাকা লাব্বাইক। ইন্নালহামদা অন্নি’মাতা লাকা, অলমুলকা লা শারীকা লাকা। (এটাকে তালবিয়াহ বলা হয়)
“হে আল্লাহ! আমি হাজির, হে আল্লাহ আমি হাজির, তোমার কোন শরীক নেই, হে আল্লাহ আমি হাজির, নিশ্চয় সমস্ত প্রসংশা, নেয়ামত ও কর্তৃত্ব, রাজত্ব তোমারই জন্য, তোমার কোন শরীক নেই।”
হে আল্লাহ তোমার ডাকে আমি উপস্থিত। তোমার কোন শরীক নেই। তোমার দরবারে উপস্থিত হয়েছি। সর্ব প্রকার প্রশংসা ও নিয়মত সামগ্রী সব কিছুই তোমার। সর্বযুগে ও সর্বত্র তোমারই রাজত্ব। তোমার কোন অংশীদার নেই। একজন হাজী যখন হজ্জে গমনের নিয়ত করে, সেই সাথে তাদের মধ্যে আল্লাহর ভয় এবং যারহেযগারী, তাওবা-ইসতেগফার এবং উন্নত ও পবিত্র চরিত্রের ভাবধারা জেগে উঠে। সে তার প্রিয় আত্মীয় ও বন্ধু-বান্ধব, সহকর্মী এবং সশ্লিষ্ট সকল লোকের কাছে বিদায় চায়। নিজের সব কাজ কারবারের চূড়ান্ত রূপ দিতে শুরু করে। এতে মনে হয় যে, সে এখন আর আগের মানুষ নয়, আল্লাহর দিকে তার মনের আকর্ষণ হওয়ায় দিল পবিত্র হয় গেছে। এভাবে একজন হাজীর এ পরিবর্তনে তার চারপাশের লোকদের উপর কত গভীর প্রভাব পড়ে তা অনুমান করা যায়। এরূপ প্রত্যেক বছরই যদি দুনিয়ার বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে গড়ে ৭০লক্ষ লোকও এই হজ্জ সম্পন্ন করে, তবে তাদের এ গতিবিধি ও কার্যকলাপের প্রভাব আরো কয়েক লক্ষ লোকের চরিত্রের উপর না পড়ে পারে না। তারপর হাজীদের কাফেলা যে স্থান অতিক্রম করে, তাদেরকে দেখে তাদের সাথে সাক্ষাত করে “লাব্বাইক” আওয়াজ শুনে সেখানকার কত মানুষের দিল আলৌকিক ভাবধারায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠে। কত মানুষের লক্ষ্য আল্লাহর ঘরের দিকে ফিরে যায়। আর কত লোকের নিদ্রিত আত্ম হজ্জ করার উৎসাহে জেগে উঠে। এসব লোক যখন আবার নিজ নিজ দেশের দিকে দুনিয়ার বিভিন্ন দিকে হজ্জের প্রাণস্পর্শী ভাবধারা বিস্তার করে প্রত্যাবর্তন করে এবং দলে দলে মানুষ তাদের সাথে সাক্ষাত করতে আসে, তাদের কাছ থেকে আল্লাহর ঘরের আলোচনা শুনে কত অসংখ্য মানুষের মনে এবং অসংখ্য পরিমন্ডলে ইসলামী ভাবধারা জেগে উঠে।
একটু চোখ বন্ধ করে চিন্তা করলেই স্পষ্ট হয়ে উঠবে যে, পৃথিবীর দূর দূরান্তের অঞ্চল থেকে আগত অসংখ্য মানুষ যাদের আকার-আকৃতি, দৈহিক রং ও ভাষা, পোশাক-পরিচ্ছদ বিভিন্ন হওয়া সত্ত্বেও যখনই কেন্দ্রের নিকটবর্তী হয় সবাই নির্দিষ্ট স্থানে এসে নিজ নিজ পোশাক-পরিচ্ছদ খুলে ফেলে এবং সকলে একই ধরনের অনাড়ম্বর “ইউনিফরম” পরিধান করে। এহরামের এ “ইউনিফরম” ধারণ করার পর পরিস্কার মনে হয় যে, দুনিয়ার হাজার হাজার জাতির মধ্যে থেকে এই যে বাছাই করা সেনাবাহিনী আসছে, এরা বিশ্বের বাদশাহ ও যমীন-আসমানের রাজাধিরাজ এক আল্লাহ তায়ালারই বিশেষ বাহিনী। এরা দুনিয়ার হাজার হাজার জাতি ও কওম থেকে ভর্তি হয়েছে। এরা সকলে একই বাদশাহার ফৌজ। এদের সকলের উপর একই সম্রাটের আনুগত্য ও গোলামীর চিহ্ন লেগে আছে, একই বাদশার আনুগত্যের দিকে, মহাসম্রাটের সামনে উপস্থিত হবার জন্য ছুটে চলছে। একই “ইউনিফরম” পরিহিত এ সিপাহী “মীকাত” অতিক্রম করে যখন সামনে অগ্রসর হয়, তখন সকলের কন্ঠ থেকে একই ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হয়ে আকাশ বাতাস মুখরিত করে তোলেঃ لَبِّيْكَ اَلَّلهُمَّ لَبِّيْكَ لَبِّيْكَ لا شَرِيْكَ لَكَ لَبِّيْكَ
উচ্চারণের কন্ঠ বিভিন্ন- কিন্তু সকলের কন্ঠে একই ধ্বনি। কেন্দ্র যত নিকটবর্তী হয়, ব্যবধান ততই কমে যায়। বিভিন্ন দেশের কাফেলা পরস্পর মিলিত হয় এবং সকলেই একত্রিত হয়ে একই পদ্ধতিতে নামায পড়ে, সকলের পোশাক এক, সকলেরই ইমাম এক, একই গতিবিধিতে ও একই ভাষায় সকলের নামায পড়া, সকলেই এক “আল্লাহু আকবার” ধ্বনির ইঙ্গিতে উঠা-বসা করে, রুকু, সিজদা করে, সকলে একই আরবী ভাষায় কুরআন পড়ে এবং শুনে। এভাবে সমবেত লক্ষ লক্ষ জনতার ভাষা, জাতি, দেশ বংশ ও গোত্রের কৃত্রিম বৈষম্য চূর্ণ হয়ে একাকার হয়ে যায়। সমগ্র মানুষের সমন্বয়ে ‘আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী’ একটি বিরাট জামায়াত রচিত হয়। তারপর এ বিরাট আন্তার্জাতিক জামায়ত একই আওয়ায ‘লাব্বাইকা লাব্বাইকা’ ধ্বনি করতে করতে চলতে থাকে। পথের প্রত্যেক চড়াই উৎরাইয়ে যখন এ আওয়াজ উচ্চারণ হয়, যখন নামাযের সময়ে এবং প্রভাতে এ শব্দ অনুরণিত হয়ে উঠে যখন কাফেলাসমূহ পরস্পর মিলিত হবার সময় এ শব্দই ধ্বনিত হয়ে উঠে তখন চারদিকে আশ্চর্য রকম পরিবেশ সৃষ্টি হয়। সে পরিবেশে মানুষ নিজেকে ভুলে যায়, এক অচিন্তনীয় ভাবধারায় সে মত্ত হয়ে পড়ে, ‘লাব্বাইকা’ ধ্বনির আকর্ষণে সে এক ভাবজগতে ছুটে যায়। অতপর কা’বায় পৌঁছে দুনিয়ার বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে সমাগত জনসমুদ্রের একই পোশাকে নির্দিষ্ট কেন্দ্র বিন্দুর চারদিকে তাওয়াফ বা প্রদিক্ষণ করা, সকলের একই সাথে সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের মাঝখানে দৌড়ানো, সকলের মিনায় উপস্থিত হয়ে তাবু জীবনযাপন করা এবং সেখানে এক ইমামের কন্ঠে ভাষণ (খুতবা) শোনা, তারপর মুযদালিফায় তাবুর নীতে রাত্রি যাপন করা, আবার মিনার দিকে সকলের প্রত্যাবর্তন করা, সকলে মিলে আকাবায় পাথর নিক্ষেপ করা, তারপর সকলের কুরবানী করা, সকলের একই সাথে কা’বায় ফিরে এসে তার তাওয়াফ করা, সকলের একই কেন্দ্রে একত্রিত হয়ে নামায পড়া এসব কাজে যে পবিত্র পরিবেশ ও আধ্যাত্মিক মনোভাবের সৃষ্টি হয়, দুনিয়ার অন্য কোন ধর্মে বা জীবন ব্যবস্থায় তার তুলনা নাই।
তারপর দুনিয়ার বিভিন্ন জাতির মধ্যে থেকে আগত অসংখ্য মানুষের একই কেন্দ্রে একত্রিত হওয়া এমন নিষ্ঠা, একাগ্রতা এবং ঐক্যবদ্ধভাবে একত্রিত হওয়া এমন পবিত্র উদ্দেশ্য ও ভাবধারা এবং নির্মল কাজ কর্ম সহকারে সমস্ত কাজ সম্পন্ন করা প্রকৃতপক্ষে আদম সন্তানের জন্য এটা এক বড় নিয়ামত। এ নিয়ামত ইসলাম ভিন্ন অন্য কোন ধর্মই দিতে পারেনি। দুনিয়ার বিভিন্ন জাতির পরস্পর মিলিত হওয়ার কোন নতুন কথা নয় চিরকালই এরূপ হয়েছে। কিন্তু তাদের এ সম্মেলন হয় যুদ্ধের ময়দানে একে অপরের গলা কাটার জন্যে। অথবা সন্ধি সম্মেলনে বিজিত দেশগুলোকে নিজেদের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা করে নেবার জন্যে কিংবা বিশ্বজাতি সম্মেলনে এক একটা জাতির বিরুদ্ধে ধোঁকা ও প্রতারণার ষড়যন্ত্র, যুলুম এবং বেঈমানীর জাল ছড়াবার জন্য; অথবা পরের ক্ষতি সাধন করে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করার মতলবে। সমগ্র জাতির জনসাধারণের নির্মল মন, সচ্চরিত্রতা ও পবিত্র মনোভাব নিয়ে এবং প্রেম ভালাবাসা, নিষ্ঠা, মানসিক ও আধ্যাত্মিক ঐক্যভাব সহকারে একত্রিত হওয়া। চিন্তা, কর্ম ও উদ্দেশ্যের পরিপূর্ণ একাগ্রতার সাথে মিলিত হওয়া তাও আবার একবার মিলিত হয়েই ক্ষান্ত না হওয়া বরং চিরকালের জন্য প্রত্যেক বছর একই কেন্দ্রে একত্রিত হওয়া বিশ্বমানবতার প্রতি এতবড় নিয়ামত দুনিয়ায় ইসলাম ভিন্ন অন্য কোন ধর্ম ব্যবস্থাই দিতে পেরেছে কি? বিশ্ব শান্তি স্থাপনে জাতিসমূহের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-কলহ মিটিয়ে দেয়া এবং লড়াই ঝগড়ার পরিবর্তে ভালবাসা, বন্ধুত্ব ও ভ্রাতৃত্বের পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্য এর চেয়ে উত্তম ব্যবস্থা আর কেউ পেশ করতে পেরেছে কি? ইসলাম শুধু এতটুকু করেই ক্ষান্ত হয়নি; সে আরো অনেক কল্যাণকর ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছে।
এই সমাবেশের পার্থিব কোন স্বার্থ নেই। শুধুমাত্র মহান রবের ডাকে সাড়া দিয়ে সমবেত হওয়া। আর প্রভুর একত্ব ঘোষণা করা। প্রভুর মাহাত্ম্য বিরাটত্ব ও প্রাধান্যকে স্বীকার করে নেয়া। এক কথায় শিরক পরিহার করে আল্লাহকে একমাত্র প্রভু হিসাবে স্বীকার করে নেয়া। সব মানুষের একই ঘোষণা মক্কা-মদীনার সারা আকাশ ও বাতাসে ধ্বনিত হতে থাকে। সে এক অভাবিত দৃশ্য। এক অচিন্তনীয় পরিবেশ। সব মানুষ তার প্রভুর কাছে হাজিরা দিতে পাগল পারা। প্রভুর ইচ্ছামত শিরক থেকে বিরত থাকার জন্য বারংবার ঘোষণা। সারা দুনিয়ার প্রভুত্ব ও কর্তৃত্ব রাব্বুল আলামীনের। এতে আর কারও শরীকানা নেই এ ঘোষণা দিতে থাকে বার বার। এটিই হল হজ্জের তালবিয়ার মৌলিকত্ব। এটিই হলো হজ্জের মূল শিক্ষা।
শেষকথা.
হজ্জ মুসলিম উম্মাহর বাৎসরিক আন্তর্জাতিক সম্মেলন। সারা দুনিয়ার মুসলিম মিল্লাত সমবেত হয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে নিম্নোক্ত ঘোষনা সমূহ দিয়ে থাকেন:
১) আমি সকল কাজে আল্লাহ তা’য়ালাকে হাজির নাজির জেনেই লাব্বাইক ঘোষনা দিচ্ছি।
২) সম্মিলিতভাবে শপথ করছি যে, আল্লাহর সাথে কোন কিছুর শরীক করবো না।
৩) শিরকমুক্ত থাকা ও শিরক মুক্ত ইবাদত করার জন্য সকলেই দৃঢ়-দীপ্ত শপথ করছি।
৪) সমস্ত প্রশংসা, মালিকানা, কর্তৃত্ব, রাজত্ব মহান আল্লাহরই, অত:এব আমরা সাধ্যমত সর্বোচ্চ কুরবানী ও ত্যাগ করার জন্য সদা প্রস্তুত থাকার দৃঢ় সংকল্প ঘোষনা করছি।
আল্লাহ তা’য়ালা আমাদেরকে পবিত্র হজ্জের মূল উদ্দেশ্য অনুধাবন করে সত্যিকার মুজাহিদ হিসেবে কবুল করুন এবং মক্কা ও মদীনা শরীফের বরকত হাসিল করে বিশ্ব মুসলিমকে ঐকবদ্ধভাবে দ্বীনের প্রতি মজবুত রাখুন। আমিন। ছুম্মা আমিন।