মহানবী (সাঃ) এর শারীরিক কাঠামো ও দৈহিক সৌন্দর্য।
প্রাথমিক কথাঃ সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শ মহামানব আমাদের প্রিয় রাসুল বিশ্বনবী মুহাম্মাদ (সা.) এর শারীরিক গঠন-প্রকৃতি ও দৈহিক সৌন্দর্য সকল দিক থেকে পূর্ণতা পেয়েছিল । যেমনিভাবে তিনি চারিত্রিক দিক থেকে ছিলেন সুমহান চরিত্রের অধিকারী- তাঁর সমকক্ষ কেউ ছিল না, দৈহিক গঠন ও সৌন্দর্যের দিক থেকেও তিনি ছিলেন তুলনাহীন । আল্লাহ তাআলার বাণী- “নিশ্চয় আপনি সুমহান চরিত্রের উপর সুপ্রতিষ্ঠিত। (সুরা ক্বলাম-০৪)
আমাদের প্রিয় নবী রাসূলুল্লাহ (সা.) সম্পর্কে বহু সংখ্যক সাহাবী অনেক চমকপ্রদ বিবরণ দিয়েছেন। মহান রাব্বুল আলামিন আল্লাহ তায়ালা সর্বোত্তম গঠনপ্রণালিতে মানবজাতিকে সৃষ্টি করেছেন। সমস্ত সৃষ্টির ওপর তাদের শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। আর সৃষ্টিজগতের শ্রেষ্ঠতম সৃষ্টি হলেন নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
সৌন্দর্যের সকল দিক যেন পূর্ণতা পেয়েছিল তাঁর মাঝে। আসুন, জেনে নিই কেমন ছিল নবীজির (সা.) শারীরিক গঠন-প্রকৃতি-
ফলে পৃথিবীর মহা মানব হিসেবে কেমন ছিল তাঁর দৈহিক সৌন্দর্য এবং গঠন।
- মহানবী (সাঃ)র দৈহিক সৌন্দর্য এবং কাঠামো:
আবু কারসানার মা এবং খালা আবু কারাসানার সঙ্গে রাসূল (সা.) এর কাছে বায়াতের জন্য আসেন। অতঃপর ফিরে যাওয়ার পথে তারা বললেন, ‘আমরা এমন .
আর দেখিনি। আমরা তাঁর মুখ থেকে আলো বিকীর্ণ হতে দেখেছি।’ (আল মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়া ১/২৫৫)।
অত্র হাদীস দ্বারা নিশ্চয়ই প্রিয় নবী মুহাম্মাদ (সা.) সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়। যদিও রাসূল (সা.) এর পবিত্র সৌন্দর্যের যথাযথ বর্ণনা করা অসম্ভব। তাইতো ইমাম কুরতুবী (রহ.) বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যদি স্বরূপে আমাদের মাঝে আবির্ভূত হতেন, তাহলে তাঁকে অবলোকন করা কারুর পক্ষেই সম্ভব হত না। (খাসায়েলে মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম – মুফতি সুলাইমান)।
আসুন, প্রিয় নবীজির দৈহিক গঠন ও সৌন্দর্য নিয়ে সামান্য কিছু আলোচনা করি।
- মহানবী (সাঃ)র চেহারা : রাসুল (সা.)-এর চেহারা ছিল খুবই লাবণ্যময় ও নূরানি। পূর্ণিমার চাঁদের মতো ঝকঝকে। দুধে আলতা মিশ্রণ করলে যে রং হয়, রাসুল (সা.)-এর গায়ের রং তেমনি ছিল।
- মহানবী (সাঃ)র আকার : খুব লম্বাও নন, খুব বেঁটেও নন, মধ্যম আকৃতির।তাঁর আগে ও পরে কখনো তাঁর মতো সুপুরুষ দুনিয়ায় জন্মগ্রহণ করেননি।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বেশী দীর্ঘ ছিলেন না,আবার বেশী খাটোও ছিলেন না: আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খুব দীর্ঘ ছিলেন না আবার খাটোও ছিলেন না। তিনি ধবধবে সাদা কিংবা বাদামী বর্ণেরও ছিলেন না। তাঁর চুল একেবারে কোঁকড়ানো ছিল না,আবার একদম সোজাও ছিল না। ৪০ বছর বয়সে আল্লাহ তা’আলা তাকে নবুওয়াত দান করেন। এরপর মক্কায় ১০ বছর এবং মদিনায় ১০ বছর কাটান। আল্লাহ তা’আলা ৬০ বছর বয়সে তাঁকে ওফাত দান করেন। ওফাতকালে তাঁর মাথা ও দাড়ির ২০টি চুলও সাদা ছিল না।[সহীহ বুখারী,হা/৫৯০০;সহীহ মুসলিম,হা/৬২৩৫; মুয়াত্তা মালেক,হা/১৬৩৯;ইবনে মাজাহ,হা/১৩৫৪৩;মুসনাদুল বাযযার, হা/৬১৮৯;শারহুস সুন্নাহ, হা/৩৭৩৫; সহীহ ইবনে হিব্বান, হা/৬৩৮৭।]
- বিশ্বনবী (সাঃ) র দেহ ছিল খুব আকর্ষণীয়,ছিলেন গৌরবর্ণের:
আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মধ্যমাকৃতির ছিলেন। বেশি লম্বা কিংবা বেশি খাটোও ছিলেন না। তাঁর দেহ ছিল খুব আকর্ষণীয়। আর তাঁর চুল বেশি কোঁকড়ানো কিংবা একেবারে সোজাও ছিল না। তিনি ছিলেন গৌরবর্ণের। পথ চলতে তিনি সামনের দিকে কিছুটা ঝুঁকে চলতেন। [মুসনাদে আবু ই’আলা,হা/৩৮৩২;শারহুস সুন্নাহ/৩৬৪০।]
চুল : রাসুল (সা.)-এর মাথার চুল ছিল কানের লতি পর্যন্ত কিছুটা কোঁকড়ানো, ঢেউ খেলানো বাবরি। বাবরি কখনো ঘাড় পর্যন্ত আবার কানের লতি পর্যন্ত থাকত। শেষ বয়সে চুল লালাভ হয়েছিল।
বারা ইবনে আযিব (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন,আমি কাঁধ পর্যন্ত লম্বা চুলবিশিষ্ট লাল চাদর ও লাল লুঙ্গি পরিহিত অবস্থায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর চেয়ে সুদর্শন কাউকে দেখিনি। তাঁর কেশগুচ্ছ ছিল কাঁধ বরাবর। তাঁর দু’কাঁধের মধ্যবর্তী স্থান অন্যদের তুলনায় কিছুটা প্রশস্ত ছিল। তিনি অধিক খাটো বা অধিক দীর্ঘাকৃতির ছিলেন না। [সহীহ মুসলিম,/৬২১১,মুসনাদে আহমাদ/১৮৫৮১।]
বিশ্বনবী (সাঃ) র মাথা : প্রিয় নবী রাসুল (সা.)-এর মাথা অপেক্ষাকৃত বড় ছিল। এ সম্পর্কে একাধারে একাধিক হাদীস পাওয়া যায়।
ঘাড় : রাসুল (সা.)-এর ঘাড় ছিল দীর্ঘ, মনোরম মাংস, কাঁধের হাড় আকারে বড় ছিল।
মোহর : দুই কাঁধের মধ্যস্থলে কবুতরের ডিমসদৃশ একটু উঁচু মাংস খণ্ড ছিল। এটাই মোহরে নবুয়াত। এতে লিখা ছিল “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ”। মোহরের উপর তিলক ও পশম ছিল এবং রং ছিল ঈসৎ লাল।
বিশ্বনবী (সাঃ) র দাড়ি : রাসুল (সা.)-এর দাড়ি ছিল লম্বা, ঘন।
হাত : হাত ও আঙুলগুলো লম্বা ছিল হাতের কবজি থেকে কনুই পর্যন্ত পশম ছিল। হাতের তালু ছিল ভরাট ও প্রশস্ত।
বিশ্বনবী (সাঃ) র বক্ষ : রাসুল (সা.)-এর বক্ষ ছিল কিছুটা উঁচু ও বীর বাহাদুরের মতো প্রশস্ত। বক্ষস্থল থেকে নাভি পর্যন্ত চুলের সরু একটা রেখা ছিল।
পেট : রাসুল (সা.)-এর পেট মোটা কিংবা মেদ-ভুড়ি ছিল না। সুন্দর সমান ছিল। বরং তাঁর পেট ও বুক সমান ছিল ।
পদদ্বয় : সুগঠিত উরু ও পদদ্বয়। দুই পায়ের গোড়ালি পাতলা ছিল। পায়ের তালুর মধ্যভাগে কিছুটা খালি ছিল। চলার সময় সামান্য ঝুঁকে মাটির দিকে দৃষ্টিপাত করে হাঁটতেন।
চামড়া : রাসুল (সা.)-এর শরীরের চামড়া রেশম থেকেও অধিক মসৃণ ও নরম ছিল।
ঘাম : রাসুল (সা.)-এর শরীরে ঘাম হলে ঘামের বিন্দুগুলো মতির মতো চমকাত। তাঁর ঘাম ছিল অত্যন্ত সুগন্ধযুক্ত।
শরীর : তিনি অত্যন্ত স্থূলও ছিলেন না, অত্যন্ত ক্ষীণকায়ও ছিলেন না। তাঁর গম্ভীর চেহারা দেখলে যেকোনো মানুষের হৃদয় প্রভাবিত হতো। মহাপুরুষের যাবতীয় লক্ষণই মহানবী (সা.)-এর পবিত্র দেহে বর্তমান ছিল।
(সূত্র: সিরাতে ইবনে হিশাম-পৃ .৪৯ বিশ্বনবী পরিচয় )
উচ্চতা: বিশ্বনবী (সা.) ছিলেন মাঝারী গড়নের।
বিশিষ্ট সাহাবী আলী (রা.) ও আনাস ইবনে মালিক (রা.) রাসূল (সা.) এর দেহাবয়বের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, রাসূল (সা.) অধিক লম্বাও ছিলেন না, আবার অতি বেটেও ছিলেন না। তবে মাঝারি গড়নের লোকদের মত ছিলেন। (বুখারী শরীফ: ১/৫০২)।
রাসূল (সা.) ছিলেন মাঝারি গড়নের। এত বেঁটে ছিলেন না যে, গণনার বাইরে। আবার এত লম্বাও ছিলেন না যে, দৃষ্টি কটু। যেন দু’টি ডালার মধ্যে তৃতীয় একটি ডালা, যা তিনটি ডালার মধ্যে সবচেয়ে বেশি চমৎকার ও দৃষ্টিনন্দন। (যাদুল মা’আদ:৫৪)।
অন্য হাদীসে এসেছে, বারা ইবনে আযিব (রাঃ) হতে বর্ণিত:রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মধ্যমাকৃতির ছিলেন। তাঁর দুই কাঁধের মধ্যবর্তী অংশ ছিল তুলনামূলক প্রশস্ত। তাঁর ঘন চুলগুলো কানের লতি পর্যন্ত লম্বা ছিল। তাঁর দেহে লাল লুঙ্গি ও লাল চাদর শোভা পেত। আমি তাঁর তুলনায় সুদর্শন কাউকে কখনো দেখিনি। [সহীহ বুখারী,হা/৩৫৫১; সহীহ মুসলিম, হা/৬২১০; নাসাঈ, হা/৫২৩২।
বর্ণ: তিনি ছিলেন শুভ্রকায় ও লাবণ্যময়: বর্ণ বলতে মূল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের গায়ের রং বোঝানো হয়েছে। বর্ণের ব্যাপারে অনেক বর্ণনা এসেছে যেমন:
সাহাবী আবু তোফায়েল বলেন, তিনি ছিলেন গৌর রং-এর, চেহারা ছিল মোলায়েম। তাঁর উচ্চতা ছিল মাঝারি ধরনের। (সহিহ মুসলিম: ২/২৫৮)।
অন্যতম সাহাবী আনার (রা.) বলেন, তিনি আযহারুল লাউন তথা লালিমা মিশ্রিত শ্বেত বর্ণের অধিকারী ছিলেন। (বোখারী শরীফ: ১/৫০২)।
আবু তুফায়েল (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন,আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে দেখেছি তবে তাকে যারা দেখেছেন তাঁদের মধ্যে আমি ছাড়া কেউ ভূপৃষ্ঠে বেঁচে নেই। (বর্ণনাকারী বললেন) আমি বললাম আপনি আমার কাছে তাঁর বিবরণ পেশ করুন। তিনি বললেন,তিনি ছিলেন শুভ্রকায় ও লাবণ্যময় সুসামঞ্জস্যপূর্ণ।[সহীহ মুসলিম/৬২১৮;মুসনাদে আহমাদ/২৩৮৪৮; আদাবুল মুফরাদ/৭৯০; শারহুস সুন্নাহ, হা/৩৬৪৮; জামেউস সগীর, হা/৮৭৫১; মিশকাত, হা/৫৭৮৫।]
রবি বিনতে মোয়াওয়েয (রা.) বলেন, তোমরা যদি রাসূল (সা.)-কে দেখতে, তখন মনে হতো যে, যেন উদিত সূর্যকে দেখছ। (মোসনাদে দারেমী, মেশকাত ২/৫১৭)।
জাবের ইবনে সামুরা (রা.) বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুখ প্রশস্ত ছিল। (সিরাতে মুহাম্মদে আরবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-মাওলানা মুহাম্মদ হাবিবুল্লাহ সাহেব কাসেমী)।
হজরত আলী (রা.) বলেন, তিনি সুন্দর গোলাপি বর্ণের ছিলেন। (শামায়েলে তিরমিযী)।
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, তিনি এত সুন্দর, নান্দনিক এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ছিলেন যেন তাঁর পবিত্র দেহখানা পূর্ণিমার চন্দ্র দ্বারা ধৌত করা হয়েছে। (শামায়েলে তিরমিযী)।
- প্রশস্ত মুখ,ডাগর চক্ষু এবং সরু গোড়ালি বিশিষ্ট : সাহাবী আলী রা বর্ণনা করেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চোখ কালো এবং লম্বা পলক ছিল।
- নাক মোবারকের বর্ণনা দিতে গিয়ে হিন্দ ইবনে আবী হালা রা. বর্ণনা করেন, রাসূলের নাক খানিকটা উঁচু , তার উপর জ্যোতির্ময় চমক। আর এ জন্য প্রথম দৃষ্টিতে বড় মনে হয়। গাল ছিল হালকা ও সমতল এবং নিচের দিকে একটু মাংসাল। (সিরাতে মুহাম্মদে আরবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-মাওলানা মুহাম্মদ হাবিবুল্লাহ সাহেব কাসেমী)।
- চোখ : প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর চক্ষুযুগলের মণি খুব কালো ছিল। চোখের পাতা ছিল খুব বড় এবং সর্বদা সুরমা লাগানোর মতো দেখাত।
- নাক: রাসুল (সা.)-এর নাক ছিল অতীব সুন্দর ও উঁচু।
- দাঁত: অতীব সুন্দর রজতশুভ্র দাঁত ছিল রাসুল (সা.)-এর। যা পরস্পর একেবারে মিলিত ছিল না, বরং সামান্য ফাঁকা ফাঁকা ছিল। হাসির সময় তাঁর দাঁত মুক্তার মতো চমকাত।
জাবির ইবনে সামুরা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন,রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মুখ প্রশস্ত ছিল। চোখের শুভ্রতার মাঝে কিছুটা লালিমা ছিল। পায়ের গোড়ালি স্বল্প মাংসল ছিল। শু’বা (রহঃ) বলেন, আমি সিমাক (রহঃ) কে বললাম(যলী’উল ফাম) কী? তিনি বললেন,বড় মুখগহ্বর বিশিষ্ট। আমি আবার বললাম (আশকালুল ’আইন) কী? তিনি বললেন, ডাগর চক্ষুবিশিষ্ট। আমি বললাম (মানুহূসুল আক্বিব) কী? তিনি বললেন,সরু গোড়ালি বিশিষ্ট।[সহীহ মুসলিম/৬২১৬;মুসনাদে আহমাদ/২১০২৪;সহীহ ইবনে হিব্বান, হা/৬২৮৯;জামেউস সগীর,/৮৯৫২,মিশকাত,/৫৭৮৪।]
- তিনি ছিলেন পূর্ণিমার চাঁদের চেয়েও চমৎকার :
জাবির ইবনে সামুরা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি একবার পূর্ণিমা রাত্রির স্নিগ্ধ আলোতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে লাল চাদর ও লুঙ্গি পরিহিত অবস্থায় দেখলাম। তখন আমি একবার তাঁর দিকে ও একবার চাদের দিকে তাকাতে থাকলাম। মনে হলো তিনি আমার কাছে পূর্ণিমার চাদের চেয়ে অধিকতর চমৎকার।[মুস্তাদরাকেহাকেম/৭৩৮৩;মারেফাতুস সাহাবা,/১৪৩৫; মিশকাত, হা/৫৭৯৪।]
আবু ইসহাক হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একবার বারা ইবনে আযিব (রাঃ) কে এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর চেহারা কি তরবারির ন্যায় ছিল?তিনি বললেন,না;বরং তা ছিল চাঁদের মতো।[সহীহ বুখারী, হা/৩৫৫২; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৮৫০১; দারেমী, হা/৬৪; সহীহ ইবনে হিব্বান, হা/৬২৮৭।]
অর্থাৎ প্রিয় নবী (সা.) এর চেহারা ছিল মায়াবী।
- তাঁর শুভ্রতা ছিল রৌপ্যের ন্যায় :
আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শুভ্রতায় ছিলেন রৌপ্যের ন্যায় এবং তাঁর চুলগুলো ছিল কিছুটা কোঁকড়ানো।[জামেউস সগীর,/৮৭৪৮;সিলসিলা সহীহাহ/২০৫৩।]
- তিনি ছিলেন ইবরাহীম (আঃ) এর সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ:
জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আমার কাছে নবীগণকে পেশ করা হয়। মূসা (আঃ) এর মধ্যে বিভিন্ন লোকের সাদৃশ্য বিদ্ধমান ছিল। তিনি যেন শানুয়াহ গোত্রের লোক। আমি ঈসা ইবনে মারইয়াম (আঃ) কে উরওয়া ইবনে মাসঊদের সাদৃশ্যপূর্ণ দেখতে পাই। তারপর আমি ইবরাহীম (আঃ) কে দেখতে পাই এবং তাকে পাই ’তোমাদের সঙ্গীর’ সাথে সর্বাধিক সাদৃশ্যপূর্ণ। তোমাদের সঙ্গী বলে তিনি নিজেকে বুঝিয়েছেন। আর আমি জিবরীল (আঃ) কে দিহইয়া (কালবী) এর সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ দেখতে পাই।[সহীহ মুসলিম/৪৪১;মুসনাদে আহমদ/১৪৬২৯ সহীহ ইবনে হিব্বান/৬২৩২ জামেউস সগীর/৭৪৫১; মিশকাত/৫৭১৪।]
দাঁত :সাহাবী হিন্দ ইবনে আবি হালা (রাযি.) বলেন, তিনি মুফালি জুল আস্নান অর্থাৎ দাঁত চিকন ছিল এবং এর মধ্যে সামনের দাঁতগুলোর মাঝে একটু ফাঁক ছিল। শুভ্রতার ব্যাপারে অন্যস্থানে বলেন, মুচকি হাসির সময় তাঁর দাঁত শিলাখন্ডের ন্যায় সাদা চকচক করে উঠত।
শ্রেষ্ঠ সাহাবী ইবনে আব্বাস (রাযি.) বলেন, তাঁর সম্মুখের দাঁতগুলি পৃথক পৃথক ছিল। অর্থাৎ মাঝে ফাঁক ছিল, ঘন ছিল না। যখন তিনি কথা বলতেন, তখন এই দাঁত হতে যেন নূর ঠিকরে পড়ত। (মেশকাত শরীফ ২য় খন্ড, ৫৭১ পৃষ্ঠা)।
- ঘাড়, কাঁধ ও বুক:
তাঁর ঘাড় অত্যন্ত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ছিল। হিন্দ ইবনে আবি হালা (রা.) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দেহাবয়ব সম্পর্কে বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, তাঁর ঘাড় এত সুন্দর ও সূক্ষ্ম ছিল, যেমন কোনো ভাস্কর্যের গর্দান। (শামায়েলে তিরমিযী)।
অন্যতম সাহাবী আলী (রা.) হতে বর্ণিত আছে, প্রিয় নবীজির সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উভয়স্কন্ধের হাড়সমূহ বড়সড় ছিল। (আর-রাহীকুল মাখতুম ৭৫২ পৃষ্ঠা)।
এমনিভাবে উম্মে মা‘বাদ খাযাঈয়া (রা.) যিনি তার স্বামীর নিকট রাসূল (সা.) এর দৈহিক বিবরণ দিচ্ছিলেন, তিনি বলেন, তার মধ্যে মেদভুড়ির ত্রুটি ছিল না, বরং তাঁর দেহ সারা জাহানের সৌন্দর্যের দীপ্তি ছড়ানো এক অপূর্ব ছবি ছিল। অর্থাৎ কোনো অপূর্ণতা ও ত্রুটি ছিল না যে, দেখতে অসুন্দর দেখাবে।
- হস্তদ্বয় ও পদদ্বয়ের তালু এবং আঙ্গুলসমূহ ছিল মাংসল :
হিন্দ ইবনে আবি হালা (রা.) বলেন, নবী কারিম (সা.) এর হস্তদ্বয় প্রশস্ত, গোশতে পরিপূর্ণ ও নরম ছিল। হিন্দ ইবনে আবি হালা (রা.) বলেন, প্রিয় নবী (সা.) এর আঙ্গুলসমূহ একই ধরনের লম্বা ছিল। অর্থাৎ অন্য লোকদের তুলনায় একটু লম্বা ধরনের ছিল।
আলী ইবনে আবু তালিব (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বেশি দীর্ঘ কিংবা বেশি খাটো ছিলেন না। তাঁর হস্তদ্বয় ও পদদ্বয়ের তালু এবং আঙ্গুলসমূহ ছিল মাংসল। তাঁর মাথা ছিল কিছুটা বড় এবং হাত-পায়ের জোড়াগুলো ছিল মোটা। বুক হতে নাভি পর্যন্ত পশমের একটি সরু রেখা প্রলম্বিত ছিল। যখন পথ চলতেন মনে হতো যেন কোন উঁচু স্থান হতে নিচে অবতরণ করছেন। বর্ণনাকারী বলেন, তাঁর পূর্বে কিংবা পরে আমি তাঁর মতো (অনুপম আকর্ষণীয়) আর কাউকে দেখিনি।[মুসনাদে আহমাদ/৭৪৬; মুস্তাদরাকে হাকেম /৪১৯৪;সহীহ ইবনে হিব্বান/৬৩১১।]
- অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের পশম ও চুল:
মানুষের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে কম বেশি সবার পশম থাকে, তবে রাসূল (সা.) এর কেমন ছিল সেটা আমাদের জানার বিষয়। সেটা জানার আগে তাঁর মাথা মোবারকের চুল সম্পর্কে খানিকটা জেনে নিই।
হজরত কাতাদাহ (রা.) বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চুল একেবারে সোজাও নয়, খুব বেশি কোঁকড়ানোও নয়।
হজরত বারা ইবনে আযেব (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চুল ঘন, কখনো কখনো কানের লতি পর্যন্ত লম্বা। কখনো ঘাড় পর্যন্ত।
হজরত আলী (রা.) বর্ণনা করেন, প্রিয় নবী (সা.) এর দেহ মোবারকে স্বাভাবিকতার অধিক পশম ছিল না। কোনো কোনো লোকের দেহে প্রচুর পশম হয়ে থাকে।
রাসূল (সা.) এর দেহ মোবারকের কোনো কোনো অংশে পশম ছিল। আবার কোনো কোনো অংশ একেবারে পশমশূন্য ছিল। পবিত্র দেহের যে সকল স্থানে পশম ছিল, বিভিন্ন বর্ণনামতে সে স্থানসমূহ হলো-
বাহুদ্বয়।
উভয় পায়ের নলী।
উভয় স্কন্ধ।
বক্ষের উপরাংশ।
কণ্ঠনালী হতে নাভি পর্যন্ত একটি সূক্ষ্ম রেখার মত ছিল।
প্রশস্ত বক্ষের অধিকারী ছিলেন এবং তাঁর বক্ষের উপরি অংশে পশমও ছিল। তবে উভয় স্তন পশম শূন্য ছিল। (শামায়েলে তিরমিযী)।
প্রিয় নবী (সা.) এর দেহাবয়বের বর্ণনায় আছে তাঁর পায়ের তলা খালি ছিল। (আর-রাহীকুল মাখতুম ৭৫২ পৃষ্ঠা)।
চামড়া: রাসূল (সা.) এর শরীরের চামড়া রেশম থেকেও অধিক মসৃণ ও নরম ছিল। (সিরাতে ইবনে হিশাম-পৃ. ৪৯, বিশ্বনবী পরিচয়-পৃ. ৭৮)।
ঘাম: রাসূল (সা.) এর শরীরে ঘাম হলে ঘামের বিন্দুগুলো মতির মতো চমকাত। তাঁর ঘাম ছিল অত্যন্ত সুগন্ধযুক্ত। (সিরাতে ইবনে হিশাম-পৃ. ৪৯, বিশ্বনবী পরিচয়-পৃ. ৭৮)।
মোহর: দুই কাঁধের মধ্যস্থলে কবুতরের ডিমসদৃশ একটু উঁচু মাংস খণ্ড ছিল। এটাই মোহরে নবুয়াত। এতে লিখা ছিল ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ।’ মোহরের ওপর তিলক ও পশম ছিল এবং রং ছিল ঈসৎ লাল। (সিরাতে ইবনে হিশাম-পৃ. ৪৯, বিশ্বনবী পরিচয়-পৃ. ৭৮)।
উপসংহার
বিশ্বনবীর সা. শারীরিক সৌন্দর্য, দৈহিক অবকাঠামো ছিল আকর্ষণীয় লাবণ্যময়ী এবং দৃষ্টি নন্দন। যেমনিভাবে মানবজাতির মধ্যে ভ্রাতৃত্ব-সংহতি ও সৌহার্দ্য-সম্প্রীপ্তি সুরক্ষা এবং সমাজ থেকে অন্যায়,অবিচার ও অসত্য দূরীভূত করে শান্তি প্রতিষ্ঠায় বিশ্বনবীর সা. এর সিরাত বা জীবন বিশ্বমানবতার জন্য মহান অনুপ্রেরণার উৎস। তিনি দল-মত-গোত্র নির্বিশেষে আরবের জাতি-ধর্ম-বর্ণ সকলের মাঝে শান্তিচুক্তি এবং সন্ধি স্থাপনের মধ্য দিয়ে ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করে সন্ত্রাসমুক্ত শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠন করেন। আল্লাহতা’লা যথার্থই বলেছেন “নিশ্চয়ই আপনি সুমহান সৎ চরিত্রের উপর সুপ্রতিষ্ঠিত।”-সুরা আল ক্বলাম:৪
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বিশ্বনবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু সাল্লাম এর আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে আমাদেরকে দুনিয়া-আখেরাতের সার্বিক কামিয়াবী দান করুন আমীন।
*লেখক,গবেষক ও কলামিস্ট
@DrKhalilurRahmanBD